FeaturedVideosদেশে দেশে হিন্দুধর্ম

মুসলিম দেশ ইরানে হিন্দু ধর্ম

ইরানে হিন্দু ধর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে একটি ইন্টারেস্টিং তথ্য জানিয়ে রাখি। শিয়া মুসলিম প্রধান ইরানে ২০১৫ সালে জনসাধারণের জন্য সর্বশেষ সুন্নী মসজিদ সরকার কর্তৃক ভেঙ্গে ফেলা হয়। বর্তমানে তেহরানের পাকিস্তানী দূতাবাসে একটি সুন্নী মসজিদ রয়েছে। এছাড়া সমগ্র ইরানব্যাপী জনসাধারণের জন্য কোন সুন্নী মসজিদ নেই। অপরদিকে হিন্দু জনসংখ্যা নগণ্য হওয়া সত্ত্বেও ইরানে দুটি হিন্দু মন্দির রয়েছে। এই মন্দির দুটো সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানবো একটু পরেই।

ইরানে হিন্দু ধর্ম

ইরান পশ্চিম এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশ। যা ঐতিহাসিকভাবে পারস্য নামে পরিচিত। এর উত্তর-পশ্চিমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান, উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর, উত্তর-পূর্বে তুর্কমেনিস্তান, পূর্বে আফগানিস্তান, দক্ষিণ-পূর্বে পাকিস্তান, দক্ষিণে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগর এবং পশ্চিমে তুরস্ক ও ইরাক অবস্থিত। ইউরেশিয়ার কেন্দ্রে এবং হরমুজ প্রণালীর নিকটে অবস্থিত হওয়ায় দেশটি ভূকৌশলগতভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

দেশটির জনগণ জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বিচিত্র হলেও এরা প্রায় সবাই মুসলিম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলটি ইসলামের শিয়া মতাবলম্বীদের কেন্দ্র।

আরো পড়ুনঃ সোনারং জোড়া মঠ ও শ্যামসিদ্ধির মঠ – উপমহাদেশের সর্বোচ্চ মিনার

হিন্দু জনসংখ্যা হাতে গুণা হলেও ইরানে দুটি হিন্দু মন্দির রয়েছে, একটি বন্দর আব্বাসে ও আরেকটি জাহেদানে। এছাড়া ইসকন কর্তৃক পরিচালিত একটি নিরামিষ রেষ্টুরেন্ট রয়েছে ইরানে। ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল প্রভুপাদ ১৯৭৬ সালে তেহরান ভ্রমণ করেছিলেন।

তেহরান থেকে ১৫০১ কিলোমিটার দূরে, দক্ষিণ ইরানের হরমুজগান প্রদেশে আছে প্রাচীন নদী বন্দর। নাম ‘বন্দর আব্বাস’। পারস্য উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত বন্দরটিতে, সুদীর্ঘ কাল ধরে ভিড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাহাজ ও নৌকা। আলেকজান্ডারের সময়ে বন্দর আব্বাসের নাম ছিল ‘হরমিজাদ’।

বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী বন্দর আব্বাস, ঊনবিংশ শতাব্দীতে হয়ে উঠেছিল ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বানিজ্যিক বিপণন কেন্দ্র। অবিভক্ত ভারতের বড় বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেই এই বন্দর আব্বাস দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার নানা জায়গায় তাঁদের পণ্য পাঠাতেন। বেশিরভাগ ভারতীয় ব্যবসায়ী ও তাঁদের শ্রমিকেরা ছিলেন হিন্দু। দেশ থেকে বহু দূরে, বছরের পর পর বছর কাটাতে হতো তাঁদের। তাই একত্রিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল একটি ধর্মস্থানের।

আরো পড়ুনঃ মরিশাসে হিন্দু ধর্ম

হিন্দু ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে একটি মন্দির স্থাপনের অনুমতি চাওয়া হয়েছিল, ‘বন্দর আব্বাস’ শহরের গভর্নর মোহাম্মদ হাসান খান সা’দলমালেকের কাছে। সহৃদয় গভর্নর হিন্দু ব্যবসায়ীদের হয়ে অনুরোধ করেছিলেন ইরানের তৎকালীন শাহ বা সম্রাট নাসের আল-দীন শাহ কাজারকে।

বন্দর আব্বাসে হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য, সম্রাট নাসের আল-দীনের অনুমতি পেতে সময় লাগেনি। অবিভক্ত ভারতের শিকারপুর নিবাসী (বর্তমানে পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশে অবস্থিত) এক ধনী ব্যবসায়ীর অর্থানুকুল্যে, ইরানের মাটিতে তৈরি হয়েছিল সুদৃশ্য এক হিন্দু মন্দির।

পাথর, কাদা, কোরাল স্টোন, বালি ও চুনের মিশ্রণে, ইরানের মাখরানা শৈলী ও ভারতীয় স্থাপত্যকলার মেলবন্ধনে তৈরি হয়েছিল অপুর্ব সুন্দর এই মন্দিরটি। মন্দিরটির উত্তর দিকে আছে তিনটি কক্ষ। মাঝের আয়তাকার কক্ষটি কাঠের তৈরি। পশ্চিমদিকে একটি ও দক্ষিণ দিকে আরও দু’টি কক্ষ আছে।

মন্দিরের মাঝখানে থাকা বিশাল বর্গক্ষেত্রাকার কক্ষটির ওপরে আছে সুদৃশ্য গম্বুজ। কক্ষের পাশ থেকে ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গিয়েছে গম্বুজের দিকে। ইরানের মাকরানা স্থাপত্যে তৈরি গম্বুজটিকে ঘিরে আছে ৭২টি ছোট ছোট পদ্মকুঁড়ি আকৃতির চূড়া। এই ধরনের চূড়া সাধারণত দেখা যায় ভারতীয় শিব মন্দিরে।

আরো পড়ুনঃ জানেন কী বৌদ্ধপ্রধান থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ ‘রামায়ণ’, রাজার উপাধী ‘রাম’

মন্দির তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পর, ১৮৯২ সালে হিন্দুদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল মন্দিরের দরজা। মন্দিরে কোন কোন বিগ্রহ ছিল জানা না গেলেও, স্থানীয় মানুষেরা বলেন মন্দিরে স্থাপন করা হয়েছিল শিবলিঙ্গ ও বিষ্ণুর বিগ্রহ। নিত্যপূজা করতেন পুরোহিত। বর্গক্ষেত্রাকার কক্ষটিতে ধূপ ও প্রদীপ জ্বালাতেন ভক্তরা।

মন্দির উদ্বোধনের মাত্র চার বছর পর, ১৮৯৬ সালের পয়লা মে, আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ইরানের শাহ নাসের আল-দীন শাহ কাজার। ইরানের বুকে মুক্তচিন্তার খোলা হাওয়া বইতে দেওয়ার জন্য হয়ত জীবন দিতে হয়েছিল শাহ নাসের আল-দীনকে।

সারা ইরান জুড়ে তৈরি হওয়া অস্থিরতার ঢেউ এসে লেগেছিল বন্দর আব্বাসেও। একে একে ইরান ছাড়তে শুরু করেছিলেন হিন্দু ব্যবসায়ীরা। যাঁর অর্থানুকুল্যে তৈরি হয়েছিল মন্দির, সেই ব্যবসায়ী ইরান থেকে ভারতে ফেরার সময় নিয়ে গিয়েছিলেন মন্দিরের বিগ্রহগুলি।

ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বন্দর আব্বাসের ঐতিহাসিক মন্দিরটি। এরপর কেটেছে দশকের পর দশক। ক্রমে অশান্ত হয়ে উঠেছিল ইরান। একসময় এসেছিল বহুকাঙ্খিত শান্তি।

আরো পড়ুনঃ কমিউনিস্ট দেশ কিউবা-তে হিন্দু ধর্ম যেভাবে বিস্তার লাভ করলো

কিন্তু দীর্ঘদিনের অযত্নে মন্দিরটির গম্বুজে দেখা দিয়েছিল ফাটল। উঁইপোকায় কুরে কুরে শেষ করে দিয়েছিল এক অসামান্য ইতিহাস। মন্দিরটি ধূলিস্যাৎ হওয়ার আগেই, মন্দিরের ওপর পড়েছিল ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মন্ত্রকের নজর।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মন্ত্রকের নেওয়া ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পর, নতুন পলেস্তারা পড়েছিল মন্দিরটির গায়ে। বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে সারানো হয়েছিল গম্বুজের ফাটলগুলি। ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ভেতরের অনবদ্য কারুকার্য্যের আগের রূপ। মন্দিরে আনা হয়েছিল বিদ্যুৎ। মন্দিরের চূড়ায় লাগানো হয়েছিল রঙিন বাতি।

বহু অর্থ ব্যয় করে ১৯৯৭ সালে মন্দিরটির আমূল সংস্কার করেছিল ইরান। ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল মন্দিরের আগের সৌন্দর্য। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মন্ত্রকের আদেশে, ইরানের ন্যাশনাল মনুমেন্টের তালিকায় আনা হয়েছিল মন্দিরটিকে। মন্দিরের ভেতরে কোনও বিগ্রহ না থাকায়, ইরান সরকার মন্দিরের মধ্যে রেখেছিল তাদের সংগ্রহ করা বিভিন্ন ভারতীয় দেবদেবীর ভাস্কর্য।

আরো পড়ুনঃ আফ্রিকার দেশ কঙ্গো-তে হিন্দু ধর্ম যেভাবে বিস্তার লাভ করলো!

মন্দিরের ভেতরের দেওয়ালগুলির মধ্যে কিছু দেওয়ালে আঁকা হয়েছিল, হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস সংক্রান্ত বিভিন্ন ছবি। ১৯৯৭ সালে তালা খোলার পর মন্দিরের গর্ভগৃহে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের দেওয়াল জোড়া ছবি। ছবিটিকেও পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল।

আজ বন্দর আব্বাসে আসা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুই হলো এই মন্দির। দূর দূর থেকে ইরানিরাও আসেন ভারতীয় মন্দির দেখতে। মন্দির চত্ত্বরে আছে ভারতীয় হস্তশিল্পের দোকান। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে এই মন্দির।

তবে দুপুর একটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। মন্দিরে প্রবেশের জন্য কাটতে হয় টিকিট। ইরানের নাগরিক হলে টিকিটের দাম পড়বে ভারতীয় টাকার মূল্যে প্রায় ২০ টাকা। বিদেশীদের জন্য ৮০ টাকা। ভারতীয় হলে নেওয়া হয় না প্রবেশমূল্য।

তবে মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা নিয়ে একসময় বিতর্ক শুরু হয়েছিল ইতিহাসবিদদের মধ্যে। কেউ বলেছিলেন পর্তুগিজরা ভারত থেকে দাস নিয়ে গিয়েছিল বন্দর আব্বাসে। তারাই বানিয়েছিল এই মন্দির। কেউ বলেছিলেন, মন্দিরটি বানিয়েছিল বন্দর আব্বাস দখলে রাখা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় সৈন্যরা। কেউ বলেছিলেন মন্দিরটি বানিয়েছিল আর্য সমাজ।

আরো পড়ুনঃ বিশ্বের সবচেয়ে বড় হিন্দু মন্দির কম্বোডিয়ার আঙ্করভাট মন্দির

কিন্তু আর্যসমাজ একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ও মূর্তিপূজার বিরোধী। আর্যসমাজ মন্দিরটি বানালে সেই মন্দিরে বিগ্রহ থাকার কথা নয়। তাহলে শিকারপুরের ব্যবসায়ীর বিগ্রহ স্থাপন করা ও পরবর্তীকালে সেগুলি ভারতে নিয়ে যাওয়ার তত্ত্বটি নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মন্দিরের দেওয়ালে শ্রীকৃষ্ণের প্রায় শতাধিক বছরের প্রাচীন দেওয়াল চিত্রটি তাহলে কারা এঁকেছিল! একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী আর্যসমাজ আঁকবে বলে মনে হয় না।

বিতর্ক থাকুক বিতর্কের জায়গায়। তবে আজও বন্দর আব্বাসের ইমাম খোমেইনি স্ট্রিটে আছে এই মন্দিরটি। যে মন্দিরকে ইরানিরা চেনেন ইন্দুস টেম্পল বা বট-ই-গোউরান নামে। সেই ঐতিহাসিক মন্দির, যেটি আজও মৈত্রীর বন্ধনে বেঁধে রেখেছে ভারত ও ইরানকে।

আরো পড়ুনঃ দুই হাজার বছর আগে অযোধ্যার রাজকন্যা যেভাবে কোরিয়ার রানী হয়েছিলেন!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!