Featuredদেশে দেশে হিন্দুধর্ম

যুক্তরাজ্যে হিন্দুধর্ম | Hinduism in UK |

১৯৭১ সালের শুমারিতে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার ০.২৫ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিল। এরপর ক্রমান্বয়ে হিন্দু জনসংখ্যা বেড়েছে।

United Kingdom বা যুক্তরাজ্য বিশ্বের একটি সুপরিচিত দেশ। খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলামের পরে হিন্দুধর্ম যুক্তরাজ্যের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম। দেশটির মোট জনসংখ্যার ১.৬% মানুষ হিন্দু ধর্ম অনুসরণ করে। উনিশ শতকের শুরু থেকেই যুক্তরাজ্যে হিন্দু ধর্মের উপস্থিতি ছিল। কেননা হিন্দু ধর্মের মূল সূতিকাগার ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ফলে ভারতীয় হিন্দুরা পড়াশোনা বা কাজের তাগিদে ওই সময়েই বিলেত তথা যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীতে চাকরীর সুবাদেও অনেক হিন্দু যুক্তরাজ্যে স্থায়ী বসতি গড়েছিলো।

১৯৭১ সালের শুমারিতে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার ০.২৫ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিল। এরপর ক্রমান্বয়ে হিন্দু জনসংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সালের সর্বশেষ তথ্য থেকে জানা যায়, যুক্তরাজ্যের হিন্দু সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১.৬ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারি থেকে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৮ লক্ষ ১৭ হাজার। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ ২১ হাজার। ২০২২ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ লক্ষে।

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত হিন্দুদের মধ্যে ১.৫ ভাগ বাস করে ইংল্যান্ডে, ০.৩১ শতাংশ স্কটল্যান্ডে, এবং ওয়েলসে ০.৩৪ শতাংশ।

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বেশীর ভাগ হিন্দু মূলত অভিবাসী, যাদের বেশীরভাগ এসেছে ভারত থেকে। যুক্তরাজ্যে উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক শ্রীলংকান ও নেপালী হিন্দু রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভুটান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিজি থেকে আগত হিন্দুও রয়েছে।

আরো পড়ুনঃ দক্ষিণ কোরিয়ায় হিন্দু ধর্ম

সাম্প্রতিক সময়ে ইসকন, BAPS স্বামী নারায়ণ সঙ্ঘ, রামকৃষ্ণ মিশন সহ বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনের প্রচেষ্ঠায়, হিন্দু ধর্মের যোগ ও ধ্যানে আকৃষ্ট হয়ে অনেক শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশও হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছেন। যাদের মধ্যে অনেক বিখ্যাত সেলিব্রেটি ও আমলা রয়েছেন। যুক্তরাজ্যের ধর্মান্তরিত হিন্দুদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন হচ্ছেন, বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড দল বিটলসের লিড গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসন, অভিনেতা রাসেল ব্র্যান্ড, দার্শনিক জন লেভি, লেখক ক্রিস্টোফার ইশরউড, হিন্দু স্কলার কেনেথ এন্ডারসন এবং ডেভিড আনন্দ্‌ হার্ট।

২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক। ঋষি সুনাক যুক্তরাজ্যের প্রথম হিন্দু প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া গ্রেট ব্রিটেনের ইতিহাসে তিনিই হচ্ছেন প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী। সমগ্র বিশ্বের হিন্দু ধর্মানুসারীদের জন্য এ এক অনন্য গৌরব।

যুক্তরাজ্যে হিন্দুদের আগমনকে তিনটি ওয়েভ বা তরঙ্গে ভাগ করা যায়। প্রথম ওয়েভ শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়। এছাড়া ষাটের দশকের শুরুর দিকে তৎকালীন হেলথ মিনিস্টার Enoch Powell ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে প্রচুর সংখ্যক ডাক্তারকে ব্রিটেনে নিয়ে আসেন। যাদের বেশীরভাগই ছিলেন হিন্দু ধর্মানুসারী।

আরো পড়ুনঃ যুক্তরাজ্যের ১ম হিন্দু প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক আসলে কে?

সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয় ৭০ এর দশকে। এ সময় উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিন উগান্ডা থেকে ভারতীয়দের বহিস্কার করলে, প্রচুর সংখ্যক হিন্দু পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। এই দশকেই ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, গায়ানা, মরিশাস ও ফিজি থেকেও প্রচুর হিন্দু ব্রিটেনে বসতি গড়েন।

তৃতীয় ওয়েভ শুরু হয় ৯০ এর দশকে। এ সময় যুক্তরাজ্যের অভিবাসন নীতি অনেকটা সহজ করা হয়। এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের হিন্দুরা পড়াশোনা ও কাজের জন্য যুক্তরাজ্যে আসতে শুরু করে। এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। করোনা মহামারীর পর যুক্তরাজ্যের স্টুডেন্ট ভিসা আরো সহজ করা হয়েছে। ফলে গত দুই বছরে অনেক হিন্দু ছাত্র-ছাত্রী যুক্তরাজ্যে গমন করেছে। এছাড়া ৯০ দশকেই শ্রীলংকা থেকে প্রচুর তামিল হিন্দু শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাজ্যে এসেছে।

United Kingdom’s Office of National Statistics এর তথ্যমতে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দুদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ছিল সবচেয়ে বেশী। ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যের হিন্দুদের গড় সম্পদ ছিল ২ লক্ষ ৬ হাজার পাউন্ড। যেখানে ব্রিটিশ খ্রিস্টানদের গড় সম্পদ ছিল ২ লক্ষ ২৩ হাজার পাউন্ড।

২০১২ সালে Trust for London এর এক সার্ভেতে দেখা যায়, লন্ডন শহরে বসবাসরত হিন্দুদের গড় সম্পদের পরিমাণ ২ লক্ষ ৭৭ হাজার ৪০০ পাউন্ড, যা ২য় সর্বোচ্চ। এক নম্বরে রয়েছে ব্রিটিশ ইহুদি, তাদের গড় সম্পদের পরিমাণ ৩ লক্ষ ১২ হাজার ৫০০ পাউন্ড।

আরো পড়ুনঃ ইসরায়েলে হিন্দু ধর্ম

যুক্তরাজ্যের অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চেয়ে হিন্দুদের উচ্চ শিক্ষার হার বেশী। ব্রিটিশ হিন্দুদের মধ্যে চাকরীর চেয়ে উদ্যেক্তা হওয়ার প্রবণতা বেশী। গত বিশ বছরে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের পর হিন্দুদের মধ্যেই ছিল সবচেয়ে কম দরিদ্র।

যুক্তরাজ্যের হিন্দুদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও কম। যুক্তরাজ্যের Ministry of Justice এর তথ্যমতে, মাত্র ০.৫ ভাগ হিন্দু গ্রেফতার, বিচার ও জেলে বন্দী হন, যা যুক্তরাজ্যে ২য় সর্বনিন্ম। কম অপরাধ প্রবণতার শীর্ষে আছে ব্রিটিশ ইহুদিরা, হিন্দুরা ২য় অবস্থানে।

Office for National Statistics এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৭৬ ভাগ হিন্দু বিভিন্ন কর্মসংস্থানে জড়িত। ফলে হিন্দুদের মধ্যে বেকারত্বের হার কম। হিন্দুদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জনই বিভিন্ন উচ্চ দক্ষতার পেশায় জড়িত।

যুক্তরাজ্যে হিন্দু ধর্মীয় প্রধান তিনটি সংগঠন হচ্ছে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব হিন্দু টেম্পলস, দ্য হিন্দু কাউন্সিল ইউকে এবং দ্য হিন্দু ফোরাম অব ব্রিটেন। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব হিন্দু টেম্পলস হচ্ছে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে পুরনো হিন্দু সংগঠন। এর অধীনে ৩০০ এর বেশী হিন্দু মন্দির ও সংগঠন রয়েছে।

দ্য হিন্দু কাউন্সিল ইউকে প্রায় ৪০০টি সাংস্কৃতিক ও হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করে। দ্য হিন্দু ফোরাম অব ব্রিটেন এর অধীনে রয়েছে ৩০০টি হিন্দু সংগঠন। আঞ্চলিক সংগঠনের মধ্যে রয়েছে Hindu Council of Birmingham.

আরো পড়ুনঃ আরব দেশ কাতারে হিন্দু ধর্ম

২০১২ সালে যুক্তরাজ্যে হিন্দু মন্দিরের সংখ্যা ছিল ১৫০টি। এর মধ্যে লন্ডন শহরেই ছিল ৩০টি মন্দির। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত স্লাউ হিন্দু কালচারাল সোসাইটি যুক্তরাজ্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ হিন্দু মন্দির। তবে যুক্তরাজ্যে প্রথম হিন্দু মন্দির স্থাপিত হয় ১৯২০ সালে, লন্ডনের আর্লস কোর্টে।

২০২০ সালে হিস্টোরিক ইংল্যান্ড নামের সংস্থা এক জরিপে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডেই মোট ১৮৭টি হিন্দু মন্দির চিহ্নিত করেছে। যুক্তরাজ্যের হিন্দু মন্দিরগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, BAPS Shri Swaminarayan Mandir Luton, Geeta Ashram, Bedford Hindu Temple, Bhaktivedanta Manor Aldenham, U.K. Nagara Shiva Temple, Shri saibaba temple, Hare Krishna Mandir (ISKCON), Jalarama Pratharna Mandal, Leicester Sri Murugan Temple, Sri Mahalakshmi Temple East Ham, London Sri Murugan Temple, Hindu Temple & Cultural Centre Edinburgh ।

যুক্তরাজ্যে যে সকল হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইসকন, স্বামীনারায়ণ সংস্থা, চিন্ময় মিশন, রামকৃষ্ণ মিশন, সাই অর্গানাইজেশন প্রভৃতি। সমগ্র যুক্তরাজ্যজুড়ে ইসকন ও বিএপিএস স্বামী নারায়ণ সংস্থার অনেকগুলো মন্দির রয়েছে।

আরো পড়ুনঃ ওমানে হিন্দু ধর্ম

২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে ৮ জন হিন্দু ব্যক্তি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া গ্রেট ব্রিটেনের বিভিন্ন পর্যায়ে অসংখ্য নির্বাচিত হিন্দু প্রতিনিধি রয়েছেন।

হিন্দু ধর্মের বিশাল সংখ্যক প্রতিনিধি যুক্তরাজ্যে বসবাস করার কারণে, হোলি, দীপাবলি, দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমীসহ প্রায় সকল অনুষ্ঠান এখানে বেশ স্বাড়ম্বরে পালিত হয়।

যুক্তরাজ্যের হিন্দুদের জন্য রইলো অনেক অনেক শুভকামনা ও ভালোবাসা।

আরো পড়ুনঃ কম্বোডিয়ায় হিন্দু ধর্ম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!