দেশে দেশে হিন্দুধর্মরামায়ণ

জানেন কী বৌদ্ধপ্রধান থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ ‘রামায়ণ’, রাজার উপাধী ‘রাম’

জানেন কী বৌদ্ধপ্রধান থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ রামায়ণ , রাজার উপাধী ‘রাম’

সনাতন ধর্মে শ্রীরামচন্দ্রের রয়েছে আলাদা এক অবস্থান। ভগবান বিষ্ণুর ৭ম অবতার হলেন রামচন্দ্র। হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে রামকে কেন্দ্র করে। শ্রীরামচন্দ্রকে ন্যায়নিষ্ঠ ও ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুবিচারসম্পন্ন ও ন্যায়নিষ্ঠ যেকোন রাজ্যকে রামরাজ্য হিসেবে অভিহিত করা হতো। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, ভগবান রামের জন্মস্থান ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অযোধ্যায়।

ভারতবর্ষ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও রামচন্দ্র পরম পূজনীয়। এসব দেশে রামের একেক নাম। লাওস ও থাইল্যান্ডে তাঁর নাম ‘ফ্রা রাম’, কম্বোডিয়ায় তাঁর নাম ‘ফ্রেয়াহ রাম’, ইন্দোনেশিয়ার জাভাতে তাঁর নাম ‘রামবিজয়’, মালয়েশিয়াতে তাঁর নাম ‘মেগাত সিরি রাম’, ফিলিপাইনসে তাঁর নাম ‘রাকা বানতুগান’।

আরো পড়ুনঃ আপনি কি জানেন রথযাত্রার আগে প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন জগন্নাথদেব?

সুদূর থাইল্যান্ডে রামচন্দ্রকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করা হয়। বৌদ্ধ প্রধান দেশ হলেও থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ রামায়ণ। থাইল্যান্ডের মানুষ এই গ্রন্থকে ‘রামাকিয়েন’ নামে ডাকেন। এমনকী সেখানে রয়েছে জাতিসংঘের ইউনেস্কো স্বীকৃত একটি নগরী, যার নাম অযোধ্যা। থাইল্যান্ডের মানুষ অবশ্য এই নগরীকে ‘অয়ুৎথ্য’ নামে ডাকেন।

সবচেয়ে বিষ্ময়কর বিষয় হলো, এই আধুনিককালেও থাইল্যান্ডে বসবাস করছে ‘রাম’ উপাধীধারী একটি রাজবংশ। কয়েক শত বছর ধরে থাইল্যান্ডের রাজসিংহাসনে যিনিই আরোহন করেন, তাঁকে ‘রাম’ উপাধী ধারণ করতে হয়। আরও বিষ্ময়কর তথ্য হলো, আজও থাইল্যান্ড সাংবিধানিকভাবে ঘোষিত ‘রামরাজ্য’।

শুনে হয়তো অবাক হচ্ছেন! অবাক হওয়ার বিষয়ই বটে! এই রহস্য উদঘাটন করতে হলে আমাদের আরও গভীরে প্রবেশ করতে হবে। বৌদ্ধ শাস্ত্র অনুসারে, বোধিসত্ত্ব একবার শ্রীরামচন্দ্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জাতকের কাহিনীতেও রামচন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। সনাতন ধর্মের মতো বৌদ্ধ ধর্মেও রামচন্দ্রকে আদর্শ রাজা ও পরম ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই বৌদ্ধ ধর্মানুসারী হয়েও থাইল্যান্ডের মানুষ ‘রাম’ উপাধীধারী রাজাকে রামের বংশধর ও বিষ্ণুর অবতার হিসেবে শ্রদ্ধা করে থাকেন।

আরো পড়ুনঃ প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের গায়ে কীভাবে এলো ডায়নোসরের ভাস্কর্য?

কীভাবে থাইল্যান্ডের রাজাদের ‘রাম’ উপাধী শুরু হয়েছিল?

১৭৮২ সালে থাইল্যান্ডের তৎকালীন রাজা বুদ্ধ য়োতফা চুলালোক নিজেই নিজের উপাধী দিয়েছিলেন ‘রাম’। তিনিই ছিলেন চক্রী রাজবংশের প্রথম ‘রাম’ উপাধীধারী রাজা। রাজা চুলালোক তাঁর রাজত্বকালে রামায়ণের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন। সেই থেকে প্রায় ২৪০ বছর ধরে চক্রী বংশীয় রাজারা ‘রাম’ উপাধী ধারণ করে শাসন করে আসছেন থাইল্যান্ড।

থাইল্যান্ডের বর্তমান রাজা ‘মহা ভজীরালঙ্গকর্ণ’ রাম উপাধীধারী দশম রাজা। তিনি ২০১৭ সালের পহেলা ডিসেম্বর ৬৩ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন। এর আগে রাজা ছিলেন তাঁর পিতা রাজা ভূমিবল, যিনি ছিলেন রাম উপাধীধারী নবম রাজা।

থাইল্যান্ড সাংবিধানিকভাবে বর্তমানে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তবে আজও থাইল্যান্ডের মানুষ রাজবংশ ও রাজাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করেন। এছাড়া সে দেশে রাজাদের বিরুদ্ধে আলোচনা-সমালোচনা করা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ।

প্রাচীনকালে থাইল্যান্ডের নাম ছিল ‘সিয়াম’। ১৬১২ সাল পর্যন্ত থাইল্যান্ড বা সিয়ামের রাজধানী ছিলো অযোধ্যা বা অয়ুৎথ্য। থাইল্যান্ডের বর্তমান রাজধানী ব্যাঙ্কক থেকে প্রায় ৮০ কি.মি. দূরে এই স্থানটির অবস্থান। ব্যাঙ্ককে অবস্থিত থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালায় রক্ষিত একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় ১২৮৫ সালের আগে এই নগরী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই শিলালিপিতে রামচন্দ্রের জীবনের নানা ঘটনাবলী অত্যন্ত নিখুঁভাবে বর্ণনা করা রয়েছে।

১৭৮০ সালে বার্মিজ আর্মি (বর্তমান মায়ানমার) দ্বারা অযোধ্যা বা অয়ুৎথ্য নগরী আক্রান্ত হয়। বার্মিজ আর্মি নগরীটিকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। রাজধানী ধ্বংস হওয়ার পর চক্রী রাজবংশের তৎকালীন রাজা বুদ্ধ য়োতফা চুলালোক ব্যাঙ্ককে রাজধানী স্থানান্তর করেন এবং নিজে ‘রাম’ উপাধী ধারণ করেন। শ্রীরামচন্দ্র সংক্রান্ত সমস্ত লিপি ও পুঁথি, অয়ুৎথ্য(অযোধ্যা) সম্পর্কিত সমস্ত প্রাচীন প্রাসাদ, মন্দির ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সরকারি সম্পত্তি হিসেবে থাইল্যান্ডে যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

আরো পড়ুনঃ আফ্রিকার দেশ কঙ্গো-তে হিন্দু ধর্ম যেভাবে বিস্তার লাভ করলো!

থাইল্যান্ডের রামায়ণ কেমন?

মূল রামায়ণের কাহিনী ও স্থান বিশাল ভারতবর্ষকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। ভারতবর্ষ থেকে রামায়ণ যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন স্বাভাবিকভাবেই এর কাহিনীতে পরিবেশগত ও ভাষাগত কিছু পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন ঘটেছে। তবে মূল চরিত্রগুলো ও ঘটনা পরম্পরা প্রায় একই রয়ে গেছে। তবে দেশভেদে বদলে গেছে রামায়ণ গ্রন্থের নাম; যেমন ইন্দোনেশিয়ার বালিতে রামায়ণকে ডাকা হয় ‘রামকবচ’, জাভাতে ‘কাকাউইন রামায়ণ, মালয়েশিয়ায় ‘হিকায়ত সেরি রাম’, ফিলিপাইন্সে ‘মারাদিয়া লাওয়ানা, মায়ানমারে ‘ইয়ামা জাতদাও’, কম্বোডিয়ায় ‘রেয়ামকের’।

একইভাবে থাইল্যান্ডে রামায়ণকে ডাকা হয় ‘রামাকিয়েন’। রামাকিয়েন শব্দটির অর্থ হলো ‘রামের কীর্তি’। থাইল্যান্ডের রাজারা রাম উপাধী ধারণের অনেক আগে খ্রিষ্টীয় তেরো থেকে পনেরো শতাব্দীতে ‘রামাকিয়েন’ লেখা হয়েছিল। থাইল্যান্ডের লোকগল্প ও লোকশিল্পে রামায়ণের গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। থাইল্যান্ড সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আজও থাইল্যান্ডে ‘রামাকিয়েন’ পালা ও পুতুল নাচ মঞ্চস্থ হয়।

আরো পড়ুনঃ মসজিদকে পাশে নিয়ে হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
error: Content is protected !!